পায়ুপথের রোগগুলোর মধ্যে পাইলস অন্যতম। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান-মাদকের অভ্যাসসহ নানা কারণে এই রোগ দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে নিয়মমাফিক চললে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু জটিলতা বেড়ে গেলে পাইলসের অস্ত্রোপচার করতে হয়। অনেক সময় অস্ত্রোপচারের পরও সমস্যা থেকে পুরোপুরি পরিত্রাণ পাওয়া যায় না।
পাইলসের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে— মলদ্বারে মাংসপিণ্ড ফুলে ওঠা, যা কখনও কখনও মলদ্বারের বাইরে ঝুলে পড়ে এবং হাত দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হয়। পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, এ রক্ত সাধারণত টাটকা লাল হয়।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন ইডেন মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের বৃহদান্ত ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. একেএম ফজলুল হক।
পায়ুপথে ক্যান্সার হলেও অনেক সময় রক্ত যায়। এক্ষেত্রে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। মলদ্বারের ভেতর বিশেষ ধরনের পরীক্ষা যেমন— সিগময়ডস্কপি বা কোলনস্কপি ছাড়া কারও পক্ষে সঠিক রোগ নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
আধুনিক প্রযুক্তির ফলে অপারেশন ছাড়াই বেশিরভাগ পাইলস রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। এ পদ্ধতির নাম হচ্ছে রিং লাইগেশন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে চিকিৎসার ফলে এখন ৮০-৯০ ভাগ পাইলস রোগী অপারেশন ছাড়াই ভালো হচ্ছেন।
প্রায়ই আমরা একটি বিব্রতকর সমস্যার সম্মুখীন হই। সেটি হচ্ছে রোগীরা জিজ্ঞাসা করেন যে, শুনেছি পাইলস অস্ত্রোপচার করলে আবার হয়। তাই আর অপারেশন করে লাভ কী? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া যায় না।
রোগীদের এ প্রশ্নর উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যালোচনা করা দরকার। রেকটাম ও মলদ্বারের অনেক রোগ আগের যুগে অপারেশন করে ভালো করা দুষ্কর ছিল।
পাইলস বা ফিস্টুলা অপারেশন করলে আবার হওয়াই ছিল নিয়ম। এ প্রসঙ্গে আমি আমেরিকান সার্জন অধ্যাপক ডা. মারভিল এল করম্যানের লেখা ‘কোলন অ্যান্ড রেকটাল সার্জারি’ নামক টেক্সট বই থেকে একটি উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে এবং এ জাতীয় সার্জারির অতীত প্রেক্ষাপটে বুঝতে সুবিধা হবে।
অধ্যাপক ডা. করম্যান তার বইয়ে লেখেন যে, বিগত দুই হাজার বছর ধরে মলদ্বারে ফিস্টুলার ওপর অসংখ্য বই ও বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা প্রমাণ করে যে, এটি একটি বিশেষ সমস্যা এবং ফিস্টুলার অপারেশনে ব্যর্থতার জন্য সার্জনদের যত বদনাম হয়েছে অন্য কোনো অপারেশনে আজ পর্যন্ত তা হয়নি।
এ কারণে ১৮৩৫ সালে ডা. স্যালমন লন্ডনের কেন্দ্রে একটি আলাদা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম দেওয়া হয় সেন্ট মার্কস হসপিটাল ফর দ্য ডিজিজেস অব কোলন অ্যান্ড রেকটাম।
যে হাসপাতালের উদ্দেশ্য ছিল বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করা এবং এ জাতীয় বিশেষজ্ঞ সার্জন তৈরি করা। যারা এ জাতীয় রোগগুলো বিশেষজ্ঞ হিসেবে নৈপুণ্যের সঙ্গে চিকিৎসা করবেন যাতে আবার হওয়ার বদনাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
মলদ্বারে সাধারণত হয় এমন তিনটি রোগ হচ্ছে পাইলস, এনাল ফিশার ও ফিস্টুলা। কিন্তু সাধারণ রোগীরা সব কটি রোগকেই পাইলস বলে মনে করেন। তাই এসব রোগের চিকিৎসার পর যখন কোনো সমস্যা হয় তখন তারা পাইলস আবার হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে পাইলস বা হেমোরয়েড বলে সেটি অস্ত্রোপচারের পর আবার হওয়ার আশঙ্কা শতকরা মাত্র ২ ভাগ। বেশিরভাগ রোগী যারা পাইলস আবারও হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা এটি বলতে সাধারণত বোঝান মলদ্বারে বাড়তি ত্বক বা মাংসপিণ্ড অথবা চুলকানি হয়েছে এটিকেও কেউ কেউ আবার পাইলস হয়েছে বলে ধরে নেন।
এ সমস্যাগুলো দ্বারা পাইলস আবার হয়েছে বোঝায় না। মলদ্বারের চুলকানি বিভিন্ন রোগের একটি লক্ষণ মাত্র।
খুবই কম অর্থাৎ শতকরা ২ ভাগ ক্ষেত্রে হলেও পাইলস আবার হতে পারে। ব্যাপারটি কি করে ঘটে তা বোঝাতে বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন। এ ব্যাপারটি ঘটার পেছনে অপারেশনের একটি কৌশলগত কারণ রয়েছে।
অস্ত্রোপচারের সময় যে শিরাগুলো স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল পরবর্তী সময়ে মলদ্বারে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় অথবা কোলেটারাল রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কয়েক বছর পর এগুলো পাইলস আকারে দেখা দিতে পারে। তাছাড়া পাইলস যখন খুব বড় হয় তখন মনে হয় মলদ্বারের চতুর্দিকের সব এলাকায় পাইলস ছড়িয়ে পড়ে।
তখন একজন সার্জনের মনে হয় সব স্ফীত অংশই কেটে ফেলে দিতে হবে নইলে পাইলস থেকে যাবে। যদি এভাবে সবকিছু কেটে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে মলদ্বার সংকুচিত হয়ে মলত্যাগে বাধা সৃষ্টি হবে।
এ ক্ষেত্রে সঠিক কৌশলটি হচ্ছে— দুটি পাইলসের মাঝখানে আমাদের বাধ্যতামূলকভাবে কিছু ঝিল্লি ও ত্বক সংরক্ষণ করতে হবে। যেহেতু এর তলদেশে পাইলসের শিরাগুলো বিস্তৃত থাকে তাই ঝিল্লির তলদেশ থেকে সতর্কতার সঙ্গে এ শিরাগুলোকে কেটে নিয়ে আসতে হবে।
এ কৌশল অবলম্বন করলে পাইলসের শিরাগুলো যেমন সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করা সম্ভব, তেমনি দুটি পাইলসের মধ্যবর্তী ঝিল্লি এবং ত্বকও সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, যাতে মলদ্বার সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না।
যা হোক অস্ত্রোপচারের পর অল্প কিছু ক্ষেত্রে যখন আবারও পাইলস দেখা দেয়, তখন এগুলোর উপসর্গ ততটা তীব্র হয় না। এটিকে তখন বিনা অপারেশনে রিং লাইগেশন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা সম্ভব। সাধারণত আবার অপারেশনের প্রয়োজন হয় না।