শারীরিক অনুশীলনের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বেশি অভ্যস্ত যেটিতে সেটি হচ্ছে দৌড়। একদম ছোট থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ব্যায়াম বলতে দৌড়ানোকেই বুঝে থাকেন। প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যায় উদ্যানগুলোতে তাই তাদের ব্যস্ত দেখা যায় এ অনুশীলনটিতে। বিশেষজ্ঞরাও এ ব্যাপারে ইতিবাচক পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই দৌড়ের সময় দেহের ভেতর যে কার্যকলাপ ঘটে তার উপকারিতার পাশাপাশি রয়েছে ভয়ানক কিছু অপকারিতাও। বিশেষত দৌড়ের সময় তরুণ, মধ্য বয়স্ক ও বার্ধক্য-পীড়িত লোকের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। আজকের ফিচারটিতে তার কারণের পাশাপাশি জানা যাবে এই ঝুঁকি কমাতে করণীয়গুলো সম্পর্কে।
দৌড়ের সময় দেহের অভ্যন্তরে ঘটিত কার্যকলাপ
দৌড়ের সময় মস্তিষ্ক ও দেহের পেশিগুলোতে অক্সিজেন পাঠানোর উদ্দেশ্যে শরীরের মাধ্যমে রক্ত দ্রুত পাম্প করার সঙ্গে সঙ্গে হৃদস্পন্দনের গতি বাড়তে থাকে।
গতির সর্বোচ্চ অবস্থায় শরীর এন্ডোরফিন নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে। এন্ডোরফিন দৌড়ের সময় পেশিগুলোতে ব্যথা হতে দেয় না এবং মেজাজ উন্নত রাখে।
দৌড়ানোর সময় শুধু পা নয়; কাজ করে গোটা শরীর। প্রথম পদক্ষেপ ফেলার মুহূর্তে দেহের কোয়াড্রিসেপ অর্থাৎ উরুর সামনের বড় পেশিগুলো সবচেয়ে বেশি কাজ করে। শরীর এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোয়াড্রিসেপ থেকে গ্যাস্ট্রোকনেমিয়াস পেশিতে স্থানান্তরিত হয়। পায়ের গোড়ালি থেকে ওপরের দিকে এবং হাঁটুর পেছন থেকে একটু নিচের অংশ যাকে পায়ের গুল বলা হয়। এই গুলের চামড়ার নিচেই থাকে গ্যাস্ট্রোকনেমিয়াস পেশি।
দৌড়ের সময় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির কারণ
দৌড়বিদদের প্রায় ২৫ শতাংশের কার্ডিওমায়োপ্যাথির ঝুঁকিতে থাকতে পারে, যা মূলত হৃৎপিণ্ডের পেশির একটি রোগ। এর ফলে হৃদপিণ্ডের জন্য শরীরের বাকি অংশে রক্ত পাঠানো কঠিন হয়ে যায় এবং যার চূড়ান্ত ফল হার্টফেল।
এ ধরনের দৌড়বাজদের ক্ষেত্রে ডান অলিন্দ এবং ডান ভেন্ট্রিকল প্রসারিত হয়। হৃদপিণ্ডের ট্রোপোনিন পেশীর সক্রিয়তা এবং হৃদপিণ্ড নিঃসৃত বি-টাইপ নেট্রিউরেটিক পেপটাইড পদার্থের বৃদ্ধি সেই প্রসারিত কুঠুরিতে একটি অস্থায়ী আঘাতের কারণ হয়। টানা ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা দৌড়ে সেই পেপটাইডের পরিমাণ পাতলা কুঠুরির তুলনায় অতিরিক্ত হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে এই ক্ষতির পুনরাবৃত্তি ঘটলে হৃদপিণ্ডের পেশিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, যা আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
এ ছাড়া রেসিংয়ের উত্তেজনা এবং চাপ হৃদযন্ত্রে সঞ্চালিত হয়। দৌড়বিদ যখন তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা অতিক্রম করেন এবং ভারসাম্যপূর্ণ হার্ট-রেট ছাড়িয়ে যান, তক্ষুণি চাপ পড়ে হৃদযন্ত্রে। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় হৃদস্পন্দন, যা ক্রমাগত কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের দিকে নিয়ে যায়।
দৌড়ের সময় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে করণীয়
রেসের আগে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেওয়া
পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া দৌড়ানো সবচেয়ে বড় ভুল। প্রথমেই চিকিৎসকের কাছ থেকে দৌড়ের জন্য শারীরিক যোগ্যতার পরীক্ষা করে নিতে হবে। ছাড়পত্র পেলে তবেই একজন যোগ্য প্রশিক্ষকের সঙ্গে দৌড়বিদদের দলে যোগ দেওয়া যেতে পারে। শুরুটা হতে হবে অবশ্যই ধীরে ধীরে। দৌড়ের সময় বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা হলে সেখানেই সেদিনের জন্য প্রশিক্ষণ থামিয়ে দিতে হবে। প্রশিক্ষণের শুরু থেকেই প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা যাবে না। প্রশিক্ষণে সহনশীলতা এবং অধ্যাবসায় দীর্ঘমেয়াদে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সামগ্রিক ঝুঁকির মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে।
রেসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ওয়ার্ম-আপ ও কিছু টেস্ট
চূড়ান্ত রেসে যাওয়ার আগে, ট্রেডমিলে বা অন্য জায়গায় হাল্কা ওয়ার্ম-আপ করে নেওয়া উচিত। স্ট্রেস, কার্ডিওলজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি এবং আলট্রাসাউন্ড টেস্টগুলো করে নিতে হবে। এগুলো বিশদ স্বাস্থ্য মূল্যায়ন যেমন রক্তে শর্করার মাত্রা, রক্তচাপ, কার্ডিয়াক চেক-আপ, লিপিড নম্বর প্রভৃতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া যাবে। রেসের জন্য আরামদায়ক পোশাক পরা আবশ্যক।
ছোট শারীরিক সমস্যাকেও গুরুত্ব সহকারে নেওয়া
দৌড়ানোর সময় বুকে অস্বস্তি, মাথা ঘোরা, ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে সঙ্গে সঙ্গে দৌড় বন্ধ করে দিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। প্রাথমিক সতর্কতা যে কোনো খারাপ দিকে মোড় নেওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। অপরদিকে এই ধরনের উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও রেসে যোগ দেওয়াটা জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে।
শরীরকে জল শূন্যতা থেকে দূরে রাখা
দৌড়বিদকে অতিরিক্ত গরম বা হাইপারথার্মিয়া এড়াতে পর্যাপ্ত জল পান করা উচিত। মাঝে মাঝে মাথা ও সারা শরীরে জল ঢালা উত্তম। ডিহাইড্রেশন এবং লবণের ক্ষতি এড়াতে দৌড়ানোর সময় উপযুক্ত তরল এবং লবণ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর অন্তর কিছু না কিছু খাওয়া উচিত। দৌড়ের আগে অবশ্যই চর্বি ও কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত। গলা যেন শুকিয়ে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শীতকালে জল শূন্যতার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
দৌড়ের আদর্শ মান
প্রতি সপ্তাহে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকে দৌড়ের জন্য আদর্শ দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মাইল। আর ধৈর্য ধরে পুরোটা পথ এক টানা দৌড়ানোর চেয়ে গতি পরিবর্তন করে করে দৌড়ানো হৃদপিণ্ডের জন্য স্বাস্থ্যকর।
দৌড় পরবর্তী প্রয়োজনীয় চেক-আপ
কার্ডিওমায়োপ্যাথির সঙ্গে দৌড়বাজের বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক অবস্থা বা দৌড়ের গতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তাই ঝুঁকির মাত্রার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র উপায় কার্ডিয়াক এমআরআই করা এবং দৌড়ের শেষে রক্ত পরীক্ষা করা।
শেষাংশ
ভারসাম্যপূর্ণভাবে পরিমিত পরিমাণে দৌড়ের অনুশীলন দৌড়ের সময় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে। মূলত এটি প্রতিটি ব্যয়ামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পরিমিত পরিমাণে সঠিক সুষম খাদ্য গ্রহণ যেমন দেহের জন্য উপকারী ঠিক তেমনি অতিরিক্ত ও অনিয়মিত দৌড়াদৌড়িতে হীতে বিপরীত হতে পারে। দিন দিন পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে খাদ্যে ভেজাল বৃদ্ধির কারণে স্বাস্থ্যের প্রতি আলাদাভাবে সতর্ক হতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, তা করতে গিয়ে যেন স্বাস্থ্যের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া না হয়।