ডেঙ্গু সাধারণত চতুর্থ দিনের মধ্যেই কমে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্বরের পরই অনেকে সুস্থ হয়ে যায়। পঞ্চম থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত সংকটকালীন পর্যায়। তখন প্লাজমা লিকেজ শুরু এবং পরবর্তী জটিলতাগুলো ধারাবাহিকভাবে দেখা দিতে পারে। কিন্তু এ বছর ডেঙ্গুতে একটু ভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা যাচ্ছে, যা আগের মতো নয়, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে।
ভিন্নতা যেমন
♦ এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম (লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ইত্যাদিতে জটিলতা দেখা দেওয়া) খুবই বিরল হলেও এবার তা বেশি দেখা যাচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি।
♦ সাধারণত তিন দিনের প্রচণ্ড জ্বরের পর তা কমে যায়। এরপর তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে অবস্থা খারাপ হওয়ার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। তখন রক্তক্ষরণ বা শক হতে পারে। এবার ব্যতিক্রম হলো, জ্বর কমার আগেই অর্থাৎ তিন থেকে চার দিনের মধ্যেই রোগীদের ব্লাড প্রেসার কমে যাচ্ছে, পেটে ও বুকে জল চলে আসছে, রোগী শকে চলে যাচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে ইত্যাদি।
♦ এবার ডেঙ্গুর গুরুতর অসুস্থতার হারও বেশি। আগে যেখানে শকে যাওয়া শিশুদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশের মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রে জটিলতা হতো, এবার সেই হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
♦ মানুষের স্বাভাবিক প্লাটিলেটের পরিমাণ দেড় লাখ থেকে চার লাখ। এত দিন প্লাটিলেট ২০ হাজারে নামতে অন্তত এক সপ্তাহের মতো সময় লাগত। এবার তেমনটি দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই ঘটে যাচ্ছে!
♦ ডেঙ্গুর যে চারটি ধরন শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর ধরনটি হলো ডেন ভি-৩। আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, এবার বেশির ভাগ মানুষ এই ধরনে আক্রান্ত হচ্ছে।
♦ ২০১৯ সালে ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। কিন্তু এবার শনাক্তের হার তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু জটিলতার হার অনেক বেশি।
জটিলতা
♦ নাক, মুখ ও খাদ্যনালিতে রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে।
♦ রক্তক্ষরণের পাশাপাশি রক্তরস (প্লাজমা) লিকেজ বা শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্তরস বেরিয়ে যেতে পারে। এ কারণে প্লাটিলেট ও শ্বেত রক্তকণিকা কমে যায়, বাড়ে হিমাক্রিট বা হিমোগ্লোবিন। এর প্রভাবে অনেকে শকে বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে চলে যেতে পারে, অর্থাৎ হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, শিরার গতি বেড়ে যায়, রক্তচাপ কমে যায়। এ বছর রক্তক্ষরণের চেয়ে রোগী শকে চলে যাচ্ছে বেশি। তাই দ্রুত চিকিৎসা না নিলে এ ধরনের রোগীর যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে।
♦ ভয়াবহ পর্যায় হলো ‘এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’। এ পর্যায়ে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডে জটিলতা দেখা দেয়। এবার জ্বর শুরু হওয়ার তিন দিনের মধ্যেই এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম শনাক্ত হচ্ছে।
চিকিৎসা ও করণীয়
♦ শিশুদের ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। শুধু করোনাভাইরাস পরীক্ষা করিয়ে সময় ক্ষেপণ করবেন না।
♦ জ্বর কমাতে শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়ান।
♦ কুসুম গরম জল দিয়ে শরীর স্পঞ্জ করান।
♦ দ্বিতীয়বার কোনো শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে নিন। কেননা দ্বিতীয়বার জটিলতা বেশি হয়।
♦ এই সময় শিশুকে জল ও মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি বেশি পরিমাণে তরল খাবার, বিশেষ করে খাবার স্যালাইন, ডাবের জল, ফলের শরবত, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়ান।
♦ শিশুদের ফুল হাতা জামা ও ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখুন। তারা বাইরে ছোটাছুটি বা খেলাধুলা করে বলে ওই সময়টায় তাদের শরীরে মশা নিরোধীকরণ স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করুন।
♦ ঘরে অ্যারোসল, মশার কয়েল ইত্যাদির ব্যবহারে শিশুর ক্ষতি হতে পারে। এর পরিবর্তে মসকিটো কিলার বাল্ব, ইলেকট্রিক কিলার ল্যাম্প, ইলেকট্রিক কয়েল, কিলার ব্যাট, মসকিটো কিলার ট্র্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।
♦ ঘুমের সময় বাসায় সবাই মশারি ব্যবহার করুন। নবজাতকদের সার্বক্ষণিক ও অন্যান্য শিশুদের দিনে ও রাতে মশারির ভেতর রাখুন।
♦ এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিছন্নতার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখুন। কোথাও জল জমতে দেবেন না।
♦ ডেঙ্গু হলেই শিশুকে হাসপাতালে নিতে হবে এমনটি নয়। তবে বেশি সমস্যা মনে হলে দ্রুত হাসপাতালে নিন। হাসপাতালেও রোগীকে মশারির ভেতর রাখুন।