সময় নষ্ট হচ্ছে তাহলে সময় নষ্ট না করে সঠিক কাজে লাগানোর ৭টি সহজ পদ্ধতি, জেনেনিন

সময় অত্যন্ত মূল্যবান। সময় আর অর্থের ব্যাপারে একটি মৌলিক সত্য হলো দুটিই আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন। এত বেশি প্রয়োজন যে সে চাহিদা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। প্রায় সবাই আমরা মনে করি আরও অর্থ পাওয়া গেলে ভালো হতো। আরও একটু সময় যদি পাওয়া যেত তাহলে কাজটা সুন্দরভাবে করা যেত।

আসলে সময়ের অভাবের কারণে কাজ সুচারুরূপে করা যায় না। পরিবারকে নিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠা যায় না, নিজেকে নিয়ে যে নিমগ্ন থাকব তাও হয়ে ওঠে না। আমাদের এই প্রজন্মের মাঝেই সময়ের অভাবজনিত হাহাকার সবচেয়ে বেশি।

হাহাকার যতই থাকুক এই ব্যাপারে সময় ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে গেলে আপনার জীবন এত বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠবে যে আপনি হাঁপিয়ে উঠবেন। আপনি স্ট্রেস বা মানসিক চাপে আক্রান্ত হবেন। অত্যন্ত নিখুঁত ব্যক্তিগত কর্ম নির্ঘণ্ট আপনার উদ্বেগকেই শুধু বাড়িয়ে দেবে। তাই নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্যে সময়ের উপর আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। নিম্নের প্রণালীগুলো অনুসরণ করলে সময়ের উপর কর্মতালিকার নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আপনার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রয়োজন নিরূপণ করুন তারপর অর্জনের চেষ্টা করুনসময় বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মতালিকা প্রণয়ন। প্রতি মুহূর্তেই হাজারটি ভিন্ন ধরনের কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোন কাজটি বিশেষভাবে করা প্রয়োজন তা নিরূপণ করতে পারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা সবকিছুই নিখুঁত সুন্দরভাবে করতে চাই। আর বড় কিছু করার তাড়না আমাদের স্নায়ুর উপর এক অবর্ণনীয় চাপ সৃষ্টি করে। তবে বড় কিছু করতে চাওয়া ও বড় কিছু করা এর মধ্যে অনেক তফাত রয়েছে। বড় কিছু করতে গেলে ছোটখাট অনেক কিছুকে এড়িয়ে যেতে হয়।

বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে উঠুন

কাজের ঝামেলা কমানোর জন্যে আপনার জমে থাকা কাজগুলোকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলুন। একটি হচ্ছে জরুরি আরেকটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি গ্রুপে অনেক তুচ্ছ বিষয়ও থাকতে পারে। যেমন বসের চিৎকার, টেলিফোনের ঘণ্টাধ্বনি এ ধরনের ব্যাপার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, তুচ্ছ বিষয় নিয়েই আমরা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি মন দিলে দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া যায় এবং সময়ও অনেক বেঁচে যায়।

দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্যের জন্যে সময় বাঁচান

সবসময় দেখবেন জরুরি কাজ করতে করতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের প্রয়োজন পূরণ করার পর দূরপ্রসারী কাজের জন্যে সময় পাওয়া যাচ্ছে না। দূরপ্রসারী লক্ষ্যের জন্যে প্রতিদিন আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা সময় ব্যয় করুন। পরবর্তী জীবনে দেখবেন এই আধঘণ্টা-একঘণ্টা সময়ই আপনাকে বড় ধরনের তৃপ্তি দিচ্ছে।

সংখ্যার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার ঠিক করুন

আপনার যা যা করা প্রয়োজন তার তালিকা প্রস্তুত করুন। তারপর গুরুত্বের ভিত্তিতে এক থেকে দশ পর্যন্ত নম্বর দিন। এক হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ, আর দশ হচ্ছে সর্বনিম্ন। এরপর তালিকার প্রতিটি বিষয়কে জরুরি ভিত্তিতে নাম্বার দিন। এক হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি, আর তিন হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম জরুরি। এরপর গুরুত্ব ও জরুরি এই দুই-এর সংখ্যাকে পূরণ করুন। যে কাজের সংখ্যা সবচেয়ে কম তাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বলে বিবেচনা করুন।

অগ্রাধিকার নিরূপণের কৌশল

অগ্রাধিকার নিরূপণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে প্রতিদিন দিনের কর্মতালিকা প্রস্তুত করা। সারাদিন কি করতে হবে লিখে ফেলুন। তারপর সবচেয়ে জরুরি কাজগুলোর পাশে ‘ক’ চিহ্ন দিন। এরপর এই কাজটি করতে কত সময় লাগতে পারে তা অনুমান করে দেখুন। যদি দেখেন সবগুলো কাজ করতে আট ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে তাহলে তালিকা সংক্ষেপ করুন। সারাদিন অনুসারে কাজগুলো করতে চেষ্টা করুন।

গুছিয়ে কাজ করুন

আমাদের অনেকেই অগোছালো অবস্থায় কাজ করি। এতে সময় লাগে বেশি। একটু সচেতনভাবে গুছিয়ে কাজ করলে সময় ও অর্থ দুইই বাঁচানো যায়। টেবিল গোছানো ও কাজের চাপ কমানোর জন্যে যে কাজগুলো আপনার অধীনস্থরা করতে পারে সেই কাগজপত্রগুলোর উপর তাদের নাম লিখে সরাসরি তাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। নিজের টেবিলে যে কাজগুলো শুধু আপনি নিজেই করবেন সেই কাগজপত্রগুলো রাখুন। অপ্রয়োজনীয় কাগজে টেবিল জাম করে রাখবেন না।

গবেষণায় দেখা গেছে, আপনার টেবিলে আসা কাগজপত্রের মাত্র ২০ থেকে ৪০ ভাগ প্রয়োজনীয় কাগজ। ৬০ ভাগ কাগজই অপ্রয়োজনীয়। আর যে কাগজগুলো আপনি ফাইল করে রাখছেন তার মাত্র ৫ থেকে ১০ ভাগ আপনার কাজে আসবে। তাই অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র নির্দ্বিধায় ফেলে দিন।

সময়ের অপচয় রোধ করুন

আমাদের যে সময় নেই তা নয়, আসলে আমাদের মনে হয় আমরা খুব ব্যস্ত। কিন্তু মূল্যবান সময়ের একটা বিরাট অংশ অপচয় হয়, এটা ঠিক। আমাদের অজ্ঞাতসারেই অনেক সময় অহেতুক নষ্ট হয়ে যায়। এই নষ্ট সময়কে বাঁচাতে পারলেও দিনে একাধিক কর্মঘণ্টা যোগ করা সম্ভব।

অনাহূত দর্শনার্থী ও ফোন

আমাদের দিনের ৫০ থেকে ৬০ ভাগ সময় অনাহূত দর্শনার্থীর সঙ্গে ও টেলিফোনে খোশালাপ করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এ রকম অনাহূত দর্শনার্থী অফিসে আপনার কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আপনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান। ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করার পরিবর্তে একটু হেসে জিজ্ঞেস করুন, ‘আমি আপনার জন্যে কি করতে পারি?’ অফিসকক্ষে দেয়ালে একটি বড় ঘড়ি রাখুন, যাতে করে আপনি প্রয়োজনবোধে ঘড়ির দিকে তাকাতে পারেন। তাহলে আপনি দেখবেন যে, আলাপ অহেতুক দীর্ঘায়িত হচ্ছে না।

কাউকে টেলিফোন করলে তাকে খুঁজে, ডেকে আনতে বলে টেলিফোন ধরে রেখে অহেতুক সময় নষ্ট করবেন না। বরং খবর দিয়ে রাখুন যে আপনি আবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে টেলিফোন করবেন। কাউকে রিংব্যাক করতে বললেও নির্দিষ্ট সময়ে রিংব্যাক করতে বলুন। টেলিফোনে আলাপ যাতে দীর্ঘায়িত না হয় সেজন্যে কাউকে অফিসে টেলিফোন করলে লাঞ্চের কিছুক্ষণ আগে অথবা অফিস ছুটির কিছুক্ষণ আগে করুন। বোকার মতো আমরা অনেক সময় কাজ করার প্রস্তুতি নিতেই প্রচুর সময় ব্যয় করে ফেলি। যেমন কাজ শুরু করার আগে এক কাপ চা বা কফি খেয়ে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া বা কোনও টেলিফোন করার আগে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া। এ সব প্রস্তুতি বাদ দিয়ে সরাসরি কাজে বসে যান এবং সেরে ফেলুন। কাজ শেষ করে নিজেকে চা বা কফি দ্বারা পুরস্কৃত করুন।

এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো নিয়ে আপনি মূল্যবান সময় বাঁচাতে পারেন। দীর্ঘসূত্রিতার হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন। সময় যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা আসলে আমরা বুঝি না। আধুনিক সভ্যতাই যে শুধু সময়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছে তা নয়, পবিত্র কোরআন শরীফেও সূরা আর রাহমান-এ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘কুল্লো ইয়াওমিন হুয়া ফিস্শান। ফাবি আইয়্যে আলায়ে রাব্বি ক্যুমা তুকাজ্জিবান।’ অর্থাৎ ‘সময়ের প্রতিটি মুহূর্তেই আমার মহিমা নব নব রূপে দীপ্যমান। তুমি আমার কোন দানকে অস্বীকার করবে?’ বস্তুত, সময়ের অপচয় করা নিজের অজ্ঞাতসারে স্রষ্টার দান ও মহিমাকে অবহেলা করারই শামিল।