কেউ বিছানায় পিঠ ঠেকালেই এক ঘুমে সকাল। কারও আবার ঘুমের মধ্যে নানা ব্যারাম। কখনও হাসি-কান্না, কখনও আবার স্বপ্নে মশগুল, কখনও ঘুমন্ত মনেও চিন্তার বজ্রআঁটুনি। সারাদিনের শত কাজের পর ঘুমের হেরফের শরীরে অবশ্যই প্রভাব ফেলে। আর সেই সুখের রাজ্যে ভিলেন যদি হয় চিন্তা, তবে ভয়ানক বিপদ।
ঘুমের ধরন দু’প্রকার। ননরেম ও রেম স্লিপ। ননরেম (নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট) স্লিপ- গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার আগে ধাপে ধাপে একজন এই পর্যায়ে যায়। প্রথমে হালকা ঘুম, তখন চোখ, হাত-পা নড়তে থাকে। তারপরের ধাপে ঘুম একটু গভীর হয়, হার্ট রেট ও শরীরের তাপমাত্রা কমতে থাকে। এর পর তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে ঘুম গভীর হয়। এই অবস্থায় শারীরিক কাজকর্ম চলতে থাকে কিন্তু মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে না। এই ধরনের ঘুমের মধ্যে মাঝে মধ্যে হালকা স্বপ্ন দেখি আমরা। কিন্তু তা ঘুম থেকে ওঠার পর মনে থাকে না। এই ধরনের ঘুমের মধ্যে হালকা স্বপ্ন দেখলেও মনের মধ্যে কোনও দুশ্চিন্তা ঘুমন্ত অবস্থায় চলতে থাকে না। এটি ঘুমের স্বাভাবিক লক্ষণ।
আর রেম (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) স্লিপ- এই ধরনের ঘুমের সমস্ত পর্যায়ে চোখ, হাত, পা বা শরীরের মুভমেন্ট অনেক বেশি থাকে। দেখা যায়, কেউ চোখ খুলেই ঘুমাচ্ছে, হাত-পা খুব বেশি সচল রয়েছে। কখনও আবার ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটাচলাও শুরু করে অনেকে। এই ধরনের ঘুমের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক অত্যন্ত বেশি সক্রিয় থাকে। ঘুমের মধ্যে মাথায় সব রকম চিন্তা কিংবা দুশ্চিন্তা জারি থাকে, স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভাঙলে মনে সেই চিন্তা পুরোটাই থেকে যায়। এতে শরীরে নানা সমস্যার উদ্রেক হয়। তাই ঘুমলেই চিন্তা মুক্তি তা সবার ক্ষেত্রে নাও হতে পারে। এটি অসুখের ঘুম।
চিন্তার ঘুমে বিপদ
স্মৃতিশক্তি লঘু: ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কোনও নতুন কিছু শেখার পর ভাল ঘুম অত্যন্ত জরুরি। কারণ পর্যাপ্ত ঘুম হলে তবেই মস্তিষ্ক সেটাকে ভাল করে গুছিয়ে নিয়ে স্মৃতিতে রাখে, অনেকটা কম্পিউটারে সেভ করার মতো। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক ঠিক করে কোন স্মৃতিকে রাখবে আর কোনটা বাতিল করবে। উলটোদিকে ঘুমের মধ্যে যদি দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্ন বেশি থাকে সে ক্ষেত্রে কোনও জিনিস শিখতে বা বুঝতেও নানা সমস্যা দেখা দেয়।
গঠনমূলক চিন্তায় বাধা: সারাদিন যা ঘটনা ঘটে, যাদের সঙ্গে যোগাযোগ বা কথাবার্তার আদান-প্রদান চলে তা আমাদের মনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে। মনের মধ্যে কোন ঘটনা বেশি স্থান জুড়ে থাকবে আর কোনটা অল্প স্থান জুড়ে তা কিন্তু মস্তিষ্কই ঠিক করে। ঘুমিয়ে চিন্তার কারণে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ঘটলে মস্তিষ্কের এই কর্মক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে। তখন একজনের কাছে সবকিছুই খুব গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। স্বভাবে উদাসীনতা প্রকাশ পায়। ফলে গঠনমূলক ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
ঘুম চিন্তার উৎস
মনের অচেতন অবস্থায় বা হালকা ঘুমন্ত অবস্থায় যা আমরা শুনি তার দ্বারাই মস্তিষ্ক কাজ করে। সেই ভিত্তিতেই শরীরে বিভিন্ন পেশি সঞ্চালন প্রতিক্রিয়া বজায় থাকে। এতে শরীরে নানা কার্যকলাপের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়। এই ধরনের আধো ঘুমের পিছনে মূল দায়ী মানসিক নানা কারণ। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন, ইউএসএ এই ব্যাপারে কারণ দর্শিয়েছেl
১. চাপা উত্তেজনা (টেনশন)
২. পুরনো কোনও ঘটনা নিয়ে ভাবনা
৩. ভবিষ্যতের চিন্তা
৪. দায়িত্বের চাপ
এ ছাড়া সারাদিনের নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনা যা অচেতন অবস্থায় ঘুমের মধ্যে মনে ঘুরতে থাকে। হতে পারে পড়াশোনা বা চাকরির অতিরিক্ত চাপ, সেলস টার্গেট অ্যাচিভ করার চিন্তা, অতিরিক্ত ব্যাঙ্ক লোন বা স্টক মার্কেটে লস হচ্ছে কি-না তাই নিয়ে ভাবনা, পারিবারিক অশান্তি- নানা কারণে ঘুমের মধ্যে চিন্তার সমস্যা বাড়তে পারে।
চিন্তা মুক্ত, ঘুম মন্ত্র
১. প্রতিদিন যোগব্যায়াম করুন।
২. ধ্যান করলে অনেক লাভ হবে।
৩. চা, কফি কখনও রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে খাওয়া নয়। মদ্যপান বা ড্রাগ নেবেন না।
৪. যে দুশ্চিন্তাগুলোর কারণে মনের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিজেই তা কমাতে চেষ্টা করুন। ভাবুন কীভাবে ধাপে ধাপে কাজ করলে চাপ কমানো সম্ভব। সেই মতো এটা কাগজে লিখে নিন চাপ কমানোর উপায়। নিজেকে আশ্বস্ত করতে হবে, যে এইভাবে চাপ কমাতে যা যা করণীয় সেগুলো করতে আপনি প্রস্তুত।
৫. ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত ৪৫ মিনিট আগে, টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপ বন্ধ করে দিন। খুব হালকা আলো জ্বালিয়ে ঘরে বসুন। প্রয়োজনে হাল্কা গান শোনা বা জটিল নয় এমন বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কোনওরকম উত্তেজক (রাগ, ঘেন্না, দুঃখ) বিষয়ে আলোচনা করবেন না।
৬. রাতে ঘুম না এলে বেশিক্ষণ শুয়ে না থেকে উঠে পড়ুন, কোনও হালকা বিষয়ের উপর বই পড়ুন। বার বার ঘড়ি দেখবেন না।
৭. সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে হতে থাকলে অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্ট বা স্লিপ স্পেশালিস্টের পরামর্শ নিন।