আপনার কি সবসময় নিজেকে ক্লান্ত লাগে! তাহলে এর পেছনে কোন কারণগুলো দায়ী জানেন কি?

মানব জীবনে কাজ করার পাশাপাশি আরেকটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ক্লান্তি অনুভব করা। হোক না সেটা ঘরের বা অফিসের কাজ, টায়ার্ডনেস আসবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ কাজ করতে করতে দিনের শেষে একদম ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিংবা কেউ দুপুর অবধি কাজ করে আর এনার্জি পায় না! এটা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। কিন্তু এই জীবনের স্বাভাবিক অংশটি যখন অস্বাভাবিক হয়ে উঠে সেটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়! কিছুক্ষণ পর পরই আপনি টায়ার্ড ফিল করছেন? সবসময় নিজেকে ক্লান্ত লাগে! এর পেছনে কী কী কারণ জড়িত থাকতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তা করেছেন কি? কেন আপনার এমনটা লাগছে, এটা কিন্তু ইনভেস্টিগেট করতে হবে আপনাকেই!

শারীরিক অবসাদের লক্ষণ
Tiredness/ Fatigue/ Exhaustion যেটাই বলেন না কেন, এই শব্দগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত, তাই না? বাংলায় যার অর্থ ক্লান্তি/ শারীরিক অবসাদ। এখন কোন পর্যায়ে গেলে এই শারীরিক অবসাদ নিয়ে চিন্তার বিষয় হতে পারে, সেটা জানা আছে কি? ৫-৬ ঘণ্টা একটানা কাজ করলেন, এতে আপনি টায়ার্ড, এই মুহূর্তে রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন, এই বিষয়টি একদমই ন্যাচারাল। কিন্তু কোনো পরিশ্রম না করেও সবসময় নিজেকে ক্লান্ত লাগলে, সেটাকে কিন্তু স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যাবে না! খুব তাড়াতাড়ি টায়ার্ড হওয়ার পাশাপাশি রেস্ট নিলেও যদি ঠিক না হয় তাহলে সেটা হয় Chronic Fatigue বা দীর্ঘদিনের অবসাদ। এর সিম্পটমগুলো অনেকটা এরকম-

মাসল পেইন
মাথা ঝিমঝিম লাগা
ডিস্টার্ব স্লিপ (বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া)
মনোযোগের অভাব
ঘুমঘুম ভাব কিন্তু ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে না
ব্রেইনের সমস্যা
ভুলে যাওয়া ইত্যাদি

সবসময় নিজেকে ক্লান্ত লাগে, কিন্তু কেন?
শারীরিক অবসাদ বিষয়টি দীর্ঘদিন বা স্বল্প মেয়াদী হোক না কেন, এটি আমাদের শরীরে কিন্তু বেশ প্রভাব ফেলে। একসময়ে ছোট ছোট সমস্যা থেকে বড় সমস্যার সূত্রপাত হয়। আমাদের খাদ্যাভাস, লাইফস্টাইল আর মেডিকেল কিছু কারণও আছে যা এর সাথে জড়িত। চলুন জেনে নেই সেগুলো।

১) অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট, সুগার ইনটেক এবং ডায়েটে প্রোটিনের অভাব
আমাদের বাঙালিদের খাবার টেবিলে ভাত (কার্বোহাইড্রেট) না থাকলে তো যায় যায় অবস্থা হয়! শরীরে কাবোহাইড্রেটের প্রয়োজন অবশ্যই আছে তবে সেটা পরিমিত। ঠিক তেমনি সুগার আইটেমসও। এই দুটি উপাদান ডায়েটে যখন বেশি পরিমাণে থাকে, তখন ব্লাড সুগার তো বাড়ে আর আপনি টায়ার্ড ফিল করেন। শরীরের মেটাবলিক রেট বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রোটিন হেল্প করে, আর প্রোটিন সমৃদ্ধ ডায়েট ওয়েট লস বা টায়ার্ডনেস কমাতে সাহায্য করে।

২) অপর্যাপ্ত এক্সারসাইজ বা ওয়ার্কআউট
আমরা অনেকেই মনে করি, ঘরের কাজ করলাম বা বাইরে ছিলাম অনেক পরিশ্রম হয়ে গেলো, আবার কীসের ওয়ার্কআউট!! মধ্য বয়স্ক অনেকেই বাসায় শুয়ে বসে দিনটা পার করে দিচ্ছেন! এর ফলে দেখা যায় যে শরীর ম্যাজম্যাজ করছে, ক্যালোরি বার্ন হচ্ছে না। যদি দিনের শুরু করেন ফ্রেশ বাতাসে মাত্র ৩০ মিনিট হাঁটাহাটি দিয়ে, তাহলে এই অযথা ক্লান্তিভাব কমে আসবে। বাসায় বসে ইয়োগা বা এক্সারসাইজও করতে পারেন। আপনার যদি সুযোগ থাকে, জিমে জয়েন করুন। এতে অনেকগুলো হেলথ বেনিফিট পাবেন, সেই সাথে মনও ভালো থাকবে।

৩) অপর্যাপ্ত ঘুম
“এই কথাটা জানি কিন্তু ক’জনে মানি” বিষয়টা এরকম! দিনশেষে আপনার শরীর না চাওয়া সত্ত্বেও আপনি কাজ করেই যাচ্ছেন, ভাবছেন যে একেবারে পরে ঘুমাবো! আর এভাবে যদি আপনি আপনার লাইফস্টাইল মেনটেইন করেন, তাহলে এটি অনেক বড় ভুল। সময়মতো না ঘুমাতে গেলে হতে পারে Sleep apnea বা স্লিপ ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যা, এতে করে ঘুমের মাঝে নিঃশ্বাসের প্রবলেম হয়। যেটা আস্তে আস্তে অন্যান্য হেলথ প্রবলেম যেমন হাই ব্লাড প্রেশার, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস ইত্যাদির সূচনা করে। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন ১৭-৬৫ বয়সের মানুষের প্রতি রাতে ৭-৯ ঘন্টা এবং ৬৫ বয়সের উপরের মানুষের জন্য ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো রেকমেন্ড করেছে।

আরেকটি কাজ যেটা করা একদমই ঠিক না সেটা হলো ঘুমানোর পূর্বে দীর্ঘক্ষণ ধরে ডিভাইস ব্যবহার করা, বিশেষ করে মোবাইল। এটি আপনার চোখের তো ক্ষতি করবেই, পাশাপাশি আপনার ঘুমের রুটিনকে ব্যাহত করে টায়ার্ডনেসও বাড়িয়ে দিবে।

৪) পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালোরি ইনটেক না করা
হেলদি ডায়েট আপনাকে সবসময় চাঙ্গা বা কর্মক্ষম রাখে। বেশিরভাগ মানুষের মিনিমাম ১২০০ ক্যালোরি দরকার। বয়স, উচ্চতা, ওজন ভেদে এটি বাড়ে ও কমে। যখন আপনি শরীরের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে বেশি বা কম খাবেন তখন মেটাবলিক প্রসেস স্মুথলি হয় না। প্রয়োজনের তুলনায় কম খেলে এই প্রসেস স্লো হয়ে যায়। এতে করে শারীরিক অবসাদ বাড়তেই থাকে, ধীরে ধীরে আপনার কর্মক্ষমতা কমে যায়, তখন সবসময় নিজেকে ক্লান্ত দেখাবে। হেলদি ডায়েট চার্ট মেনটেইন করুন, নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া দাওয়া করে নিন। এতে করে শারীরিকভাবে ভালো থাকাটা অনেকটা নিশ্চিত হবে। ওজন কমাতে যেয়ে আন্দাজে ডায়েটিং শুরু করবেন না!

৫) বডি ডিহাইড্রেটেড থাকা
শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য জলের কোনো বিকল্প নেই। দৈনিক আট গ্লাস জল পান করা উচিত। এখন একটু ভাবুন, আজকের দিনে কয় গ্লাস জল পান করেছেন? মজার বিষয় হলো, হাইড্রেটেড থাকতে গিয়ে অনেকে সফট ড্রিংকস প্রিফার করেন। একটু টায়ার্ড হলেই ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানীয় বের করে নেন! সাময়িকভাবে তৃষ্ণা মিটবে ঠিকই কিন্তু বডিতে জমা করলেন হিউজ সুগার! এর থেকে বরং ডাবের জল বা বাসায় তৈরি ফলের জুস পান করুন। এতে শরীরের অবসাদ তো দূর হবেই, সেই সাথে ত্বক হবে সুন্দর ও লাবণ্যময়।

৬) হাই স্ট্রেস লেভেল
স্ট্রেস আর অবসাদ, এটা দু’টো টার্ম যেন একটি অন্যটির পরিপূরক। কোনো ইস্যু নিয়ে যদি আপনি সিরিয়াস লেভেলে স্ট্রেসড থাকেন, তাহলে ক্লান্তির ছাপ তো আপনার শরীরে পড়বেই!

৭) ডায়াবেটিস
সবসময় নিজেকে ক্লান্ত লাগছে? একটু চেক করে দেখবেন আপনার সুগার লেভেল। ডায়াবেটিস হবার জন্য আপনার বয়স কিন্তু ফ্যাক্টর না। যেকোনো বয়সেই হতে পারে। যারা বার বার কারণে অকারণে টায়ার্ড ফিল করেন, তারা অবশ্যই ব্লাড সুগার আগে চেক করবেন। এসব ক্ষেত্রে Type 2 বা ডায়েট রিলেটেড ডায়াবেটিস হয়ে থাকে।

৮) থাইরয়েড ইস্যু
আপনার হরমোন লেভেল ঠিক আছে কিনা এজন্য পরীক্ষা করা উচিত। কেননা অতিরিক্ত শারীরিক অবসাদের আরেকটি কারণ হলো থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। এর ফলে মেটাবলিজম প্রসেস স্লো হতে থাকে। সবসময় নিজেকে ক্লান্ত লাগে, একটু কাজ করলে দুর্বল লাগে, এই ধরনের অনেক সমস্যাই হতে পারে।

৯) কিডনিজনিত সমস্যা
আপনার কিডনি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে ব্লাডে টক্সিন এর পরিমাণ বাড়ে। যার কারণে ঘন ঘন টায়ার্ডনেস আসে। দেখবেন যাদের রেনাল ডিজিজের শেষ পর্যায়ে ডায়ালাইসিস করাতে হয়, তারা অধিকাংশ সময় ক্লান্ত অনুভব করেন।

১০) অ্যানিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা
বডিতে যখন আয়রন ডেফিসিয়েন্সি হয়, তখন এই রক্ত স্বল্পতার সূত্রপাত ঘটে। বডি যদি এনাফ রেড ব্লাড সেল প্রোডিউস না করে তাহলে বডির বিভিন্ন অরগানে অক্সিজেনের প্রয়োজন মেটাতে রক্ত কণিকা সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে আপনি অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন, কোনো এনার্জি থাকে না। তাই অযথায় যদি ক্লান্ত লাগে, ব্লাড টেস্ট করিয়ে দেখতে পারেন।

১১) ভিটামিনের অভাব
পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি-১২, এবং ভিটামিন ডি ইনটেক না করলে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে খুব সহজেই। ভিটামিন বি-১২ ব্রেইন হেলথ এর জন্য ক্রুশিয়াল উপাদান। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর অভাব হতে থাকে শরীরে, তাই ডায়েট চার্টে ভিটামিনযুক্ত খাবার রাখুন।

সবশেষে এটাই বলতে চাই, নিজের শরীরে পরিবর্তনগুলোকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করুন। যদি বার বার এই টায়ার্ডনেস ফিল করেন বা ঘন ঘন অসুস্থ বোধ করেন, তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। সেই সাথে অতি পরিচিত পুরানো কথা Prevention is better than cure এটি কাজে লাগান দৈনন্দিন জীবনে। পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, রেগুলার এক্সারসাইজ, পরিমিত এবং সঠিক সময়ে ঘুম, স্ট্রেস ফ্রি থাকা- এই ছোট ছোট পরিবর্তনেই আপনি ভালো থাকতে পারবেন খুব সহজে। তাহলে আজ এই পর্যন্তই, শুভ কামনা সকলের জন্য।