ক্যান্সার বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। জরায়ু মুখের ক্যান্সার তার মধ্যে একটি। বেশিরভাগ নারীরাই এই রোগে আক্রান্ত হয়। লজ্জাস্থান বলে অনেক নারীই এর যন্ত্রণা নিরবে সয়ে যায়। একসময় যার ফলাফল হয় মৃত্যু। তাই জরায়ু মুখে ক্যান্সার সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরী। জরায়ুর মুখের ক্যান্সার জরায়ু মুখের কোষ থেকেই শুরু হয়। জরায়ু মুখের স্কোয়ামাস সেল থেকেই বেশি হয়ে থাকে। এই কোষ হচ্ছে জরায়ুর নিচে সংযুক্ত অংশ এবং যোনির উপরের অংশ। আপনি কি জানেন, বিশ্বে নারীদের সকল ক্যান্সারের মধ্যে এটি দ্বিতীয় এবং ক্যান্সার জনিত মৃত্যুতে এটি পঞ্চম। বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে এক জন নারী এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। অথচ একটু সচেতনতা এটি প্রতিরোধ করতে সক্ষম। চলুন জেনে নেয়া যাক এই সম্পর্কে কিছু তথ্য-
জরায়ু মুখের ক্যান্সার হওয়ার কারণ
হিউম্যান পেপিলমা ভাইরাসের কারণে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাই এটিই প্রধান কারণ। এই ভাইরাসের মধ্যে হাই রিস্ক কিছু স্ট্রেইন আছে যার প্রতিরোধক ভ্যাক্সিন আছে। বাকিগুলোর জন্যে ভ্যাক্সিন নেই। তাই রেগুলার চেক আপে থাকা উচিত, বিশেষ করে চল্লিশ ঊর্ধ্ব মহিলাদের। কিছু রিস্ক ফ্যাক্টরও এড়িয়ে চলতে হবে। জরায়ু মুখের ক্যান্সার হওয়ার রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলো-
১. অল্প বয়সে বিয়ে করা।
২. অল্প বয়সে বাচ্চা নেয়া।
৩. কোনো ব্যক্তির পূর্বের স্ত্রীর এই রোগ হয়ে থাকলে, তার সাথে যৌন মিলন কর।
৪. একাধিক ব্যক্তির সাথে যৌন মিলন করা।
৫. ঘন ঘন বা অধিক বাচ্চা নেয়া।
৬. জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার করা।
৭. ইনফেকশন – এইচ.আই.ভি., হিউম্যান পেপিলমা , ক্লামাইডিয়া ভাইরাসে ইনফেকশন ।
এই কারণগুলো একজন নারীর শরীরে ক্যান্সার দানা বাঁধায় সহায়ক। সঠিকভাবে এই বিষয়গুলো এড়িয়ে গেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ
১০ বছরের পর থেকেই জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধক ভ্যাক্সিন নেয়া যায়। একবার ক্যান্সার হয়ে গেলে ভ্যাক্সিন কোনো কাজে আসেনা। তিনটি ডোজ আছে। প্রথমটির এক মাস পরে দ্বিতীয় টিকা এবং তারও পাঁচ অর্থাৎ প্রথমটির ছয় মাস পরে তৃতীয় ডোজের টিকাটি নিতে হবে। জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে pap smear টেস্ট করুন।
এটি একটি স্ক্রিনিং টেস্ট। প্রতি ৩ থেকে ৫ বছরে একবার করানো ভালো। ২১ বছরের পর থেকেই করা যায়। ৪০ বছরের পর থেকে নিয়মিত করা উচিত, ৫০ এর পর থেকে বছরে একবার করালে আরও ভালো। ভ্যাক্সিন দেয়া থাকলেও টেস্ট করাতে হবে। আগেই কোষে ক্যান্সার হবার মত পরিবর্তন ধরা পড়ে গেলে লেজার এব্লেশন, ক্রায়ো থেরাপি সহ আরও চিকিৎসার মাধ্যমে এটি প্রতিকার করা যায়।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার হওয়ার লক্ষণসমুহ
শুরুর দিকে এর কোন লক্ষণ সাধারণত থাকেই না। এই রোগের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ গুলো হচ্ছে –
১. যোনিপথে রক্তপাত, সহবাসের সময় রক্তপাত বা কোনো কিছুর স্পর্শে রক্তপাত।
২. যোনিপথে দুর্গন্ধযুক্ত নিঃসরণ।
৩. ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধা মন্দা, শরীর অবসন্ন লাগা।
৪. কাশি ও কাশিতে রক্ত আসা।
৫. ডায়রিয়া, পায়খানার সাথে রক্ত আসা , প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া , ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
৬. রক্ত শূন্যতায় ভোগা।
৭. পিঠে ব্যথা, তলপেটে ব্যথা, পায়ে ব্যথা ও পা ফুলে যাওয়া।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার হলে চিকিৎসা
স্টেজ এর উপর ভিত্তি করে একেক স্টেজে একেক চিকিৎসা দেয়া হয়। সার্জারি, রেডিও এবং কেমোথেরাপি এই তিন ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। সাধারণ কিছু চিকিৎসা মূল চিকিৎসার পাশাপাশি দেয়া হয়। লক্ষণের উপর নির্ভর করে ব্যথানাশক, এন্টিবায়োটিক, ব্লাড ট্রান্সফিউশন ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় স্টেজে সার্জারি করা হয়। লাস্ট হয়ে গেলে সার্জারি করে লাভ হয় না কারণ ক্যান্সারের বীজ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সব স্টেজেই রেডিও থেরাপি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সার্জারি করার অনেক আগেই রেডিওথেরাপি দিয়ে এর সাইজ কমিয়ে আনা হয়। কেমোথেরাপি ডাক্তার প্রয়োজন বুঝে দিয়ে থাকেন। অপারেশনের পরে নিয়মিত ফলো আপ জরুরী। ৩ মাস অন্তর প্রথম ১ বছর, ছয় মাস অন্তর পরের ১ বছর ও এরপর এক বছর অন্তর অন্তর ফলো আপ করাতে হবে।
দেশের সমীক্ষা
২০১০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশে প্রতি বছর জরায়ু মুখ ক্যান্সারে নতুন করে আক্রান্ত হন ১৩ হাজার নারী এবং মারা যান ৬ হাজার ৬০০ জন। সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়। আর দিনের হিসাবে সংখ্যাটিও চমকে দেয়ার মত, গড়ে ১৮ জন। সরকার ভ্যাক্সিন প্রয়োগের জন্য সমাজ সচেতনতা মূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। আশা করা যায় ২০২০ এর মধ্যে জরায়ু মুখ ক্যান্সারে মৃত্যুর হার কমে আসবে।